কক্সবাজারে পাওয়া গেল মহাবিপন্ন গিটারফিশের নতুন প্রজাতি

প্রথম আলো •

মাছটি দেখতে অনেকটা গিটারের মতো। কক্সবাজারের যেসব জেলেরা বঙ্গোপসাগরে যান, তাঁরা একে ‘পিতাম্বরী মাছ’ নামে ডাকেন। বাংলাদেশে কালে–ভদ্রে ধরা পড়া মহাবিপন্ন প্রজাতির এই মাছটিকে। বিশ্বজুড়ে মাছটিকে ডাকা হয় ‘জায়ান্ট গিটারফিশ’ নামে। বিশ্বের প্রাণী বিজ্ঞানীরা এতদিন জানতেন, এই জাতীয় মাছের মোট ১১টি প্রজাতি আছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে এই মাছের আরেকটি প্রজাতি পাওয়া গেছে, যা বিশ্বে মাছের প্রজাতিতে নতুন একটি সংযোজন ঘটলো।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবিব ও গবেষক মো. জায়েদুল ইসলাম যৌথভাবে মাছটি আবিষ্কার করেছেন। বিশ্বে ৩৪ হাজার ৫০০ প্রজাতির মাছের সঙ্গে এটি একটি নতুন সংযোজন হলো।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীর ওই মাছটির নাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশি জায়ান্ট গিটারফিশ’। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অ্যাকোয়াটিক বায়োরিসোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে পুরো গবেষণাটি হয়েছে। মাছটির দেহের গঠন, বাহ্যিক আকৃতি ও ডিএনএ বারকোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রজাতিটি শনাক্ত করা হয়। গত মঙ্গলবার বিজ্ঞান সাময়িকী ‘জুটাক্সা’তে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ওই মাছটিকে বিশ্বের নতুন এক মাছের প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

মৎস্য বিজ্ঞানীরা জানান, গিটার মাছ মূলত শাপলা পাতা ও হাঙ্গর প্রজাতির মাঝামাঝি এক প্রজাতির মাছ। এটি মূলত ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায়। চীন, থাইল্যান্ড, জাপানসহ পূর্ব–এশিয়ার দেশগুলোতে এই মাছের পাখনা থেকে তৈরি করা স্যুপ বেশ জনপ্রিয়। ফলে এই মাছটি ধরা পড়লে বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়। যে কারণে খুব দ্রুত এই মাছের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে কমে আসছে।

মাছের প্রজাতি শনাক্তকরণের এই গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে মহাবিপন্ন প্রজাতির এই মাছটি বঙ্গোপসাগরের উত্তর অংশে পাওয়া গেছে। ফলে এটি যাতে ধরা না হয় এবং এটিকে বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিলভুক্ত, হত্যা এবং ধরা যাবে না এমন তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা উচিত।

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং এদের ডিএনএ বারকোডিং গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য মাছটির প্রধান আবিষ্কারক অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার কোরিয়ার সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ইউনহোলির নামে মাছটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম গ্লুকোসটেগাস ইউনহোলি (Glaucostegus younholeei)। মাছটি রাইনোবেটিফরমিস বর্গের, গ্লুকোসটেগিডি ( Glaucostegidae) পরিবারের।

বিজ্ঞাপন

এই পরিবারের প্রজাতিগুলোকে জায়ান্ট গিটারফিশ বলা হয়। নতুন এ প্রজাতিটি যোগ হওয়ায় পৃথিবীতে জায়ান্ট গিটারফিশের শনাক্ত হওয়া প্রজাতি দাঁড়াল আটটি। দুটি প্রজাতি ছাড়া বাকি সব সামুদ্রিক লোনা পানিতে থাকে। তবে দুটি প্রজাতি মাঝে মাঝে কিছুটা লোনা পানিতে মাঝে মাঝে বিচরণ করে।

প্রকৃতিবিষয়ক সংস্থাগুলোর আর্ন্তজাতিক জোট আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রাপ্ত গিটারফিশরা মহাবিপন্ন। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গিটারফিশদের সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সংস্থাটি উদ্যোগ নিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং হাঙ্গর–শাপলা পাতা মাছবিষয়ক গবেষক আলিফা বিনতে হক প্রথম আলোকে বলেন, এই মাছটি সমুদ্রের কম গভীর এলাকায় থাকে। সমুদ্রের ২০ থেকে ৩০ মিটার গভীরে এটি পাওয়া যায়। ফলে এটি বরশিসহ জালে ধরা পড়ে। ফলে এটিকে রক্ষা করতে হলে জেলেদের সচেতন করতে হবে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অর্থায়নে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে হাঙ্গর ও শাপলাপাতা জাতীয় মাছের প্রজাতি শনাক্তকরণ ও সংরক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ে করা একটি গবেষণার সময় ২০১৯ সালের জুনে এই মাছটি গবেষক দলটি প্রথম খুঁজে পান। পরে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত দলটি মোট ১৬ বার মাছটি খুঁজে পান। কিন্তু দেখতে গিটার প্রজাতির অন্য মাছের মতো হওয়ায় শুরুতে এটি যে নতুন প্রজাতি তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গবেষণা প্রতিবদেনটিতে বলা হয়েছে, মাছটি ৭৩০ থেকে ৯৩৩ মিলিমিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্য বা লম্বা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে এটি প্রথম চিহ্নিত করা হয়। মাছটির শরীরের রং বাদামী এবং ধুসর হয়ে থাকে।